মৃত্যু নিয়েও রাজনীতি?


মেহেদী হাসান মোল্লা: মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি এই বাংলায় নতুন ঘটনা নয়।শুধু বাংলায় কেন মৃত্যু রাজনীতি মনে হয় এ দেশের মজ্জায়, রক্তে রক্তে মিশ্রিত।উত্তরপ্রদেশের হাসপাতালে কচি কচি নিষ্পাপ মৃত শিশুর মুখ,গুজরাটে মৃত শিশুর শব নিয়ে রাজনীতি তার জলন্ত উদাহরণ।তাই বাংলায় ডেঙ্গি মৃতু নিয়ে যে রাজনীতি হচ্ছে বা ভবিষ্যতে যদি আরও বড় রাজনীতি হয় তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।বিগত কয়েক মাস ধরে ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগ এই বাংলায় মহামারির চেহারা নিয়েছে।অথচ এই অপ্রিয় সত্য কথাটা মানতে নারাজ শাসক দল।বিরোধী দল ও ক্ষমতাশীল দল মেতে উঠেছে এক কুৎসিত রাজনীতিতে।শুরু হয়েছে একে অপরের দোষারোপের পালা।আর তারই মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের মৃত্যু দিয়ে।তারা একবার ও ভেবে দেখছে না যে প্রতিনিয়ত যে মুখগুলো অকালে ঝরে পড়ছে,কি ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবার গুলো।মৃত্যুর কোন সান্তনা হয় না,এই অভাবও কেউ মেটাতে পারে না।অথচ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর যেন 'ডেঙ্গি' শব্দটাতেই অ্যালার্জি।তিনি মানতে নারাজ যে এই রাজ্যে মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু ভাইরাসের আক্রমণ।তাঁর মতে কোন এক অজানা জ্বরেই মৃত্যু হচ্ছে সাধারণ মানুষের।তাঁর বিবৃতি অনুযায়ী-গুজরাটের মত রাজ্যে ডেঙ্গি,অজানা জ্বর,সোয়াইন ফ্লু তে ৪৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে,মহারাষ্ট্রে ৬৯৫ জনের,রাজস্থানে ২৩০ জনের,তামিলনাড়ুতে ১২০ জনের,কেরলে ১১১ জনের এবং বাংলায় সরকারিভাবে ১৩ জনের ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয়েছে,বাকি ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে।তাদের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী জানান-এদের মৃত্যু যে ডেঙ্গিতে হয়েছে তা ভাল করে যাচাই না করে বলা যাচ্ছে না।শাসক দল কি তাহলে অন্য রাজ্যের মৃত্যুর খতিয়ান দিয়ে নিজের রাজ্যকে আড়াল করার চেষ্টা করছে ?মুখ্যমন্ত্রীর দাবী ডেঙ্গি নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল গুলি।আতঙ্ক ছড়িয়ে ব্যবসা করছে প্যাথলজিকাল ল্যাব গুলো।ল্যাবরেটরি গুলি নিয়ে যদি এতই অসুবিধা থাকে তাহলে সরকারি হাসপাতালে,প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলিতে অতি দ্রুত এবং সঠিক পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হোক। 

ডেঙ্গি পরীক্ষার সবথেকে ভাল পদ্ধতি  ELISA টেস্টের ব্যবস্থা করা হোক সর্বত্র।সরকারি হাসপাতাল গুলোতে যদি সঠিক উপায়ে এবং সঠিক পরিমানে রক্ত পরীক্ষা করার ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো থাকে,তাহলে তো আর সাধারণ মানুষকে হয়রানির স্বীকার হয়ে টাকার বিনিময়ে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটতে হয় না। বহু মানুষ বিভিন্ন জেলা, মহাকুমা হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গুলিতে এসেও ভর্তি হতে না পেরে অবশেষে বেসরকারী হাসপাতালে ঠাঁই জুটেছে।হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরে চিকিৎসার অভাবে মৃত্ত্যু হয়েছে বহু।এই পরিস্থিতি আবারও সরকারের চিকিৎসা ব্যবস্থার রেফারেল সিস্টেমের আসল চিত্রটা ফুটিয়ে তুলল।কেন জেলা বা মহাকুমা হাসপাতাল থেকে সঠিক তথ্য দিয়ে রেফার করা হচ্ছে না সেটা জাচাই করা উচিৎ প্রশাসনের।জেলা ও মহাকুমা হাসপাতাল গুলিকে অনেক উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও কেন ডেঙ্গি রোগীকে কোন যুক্তিতে রেফার করা হচ্ছে সেটাও তলব করা উচিৎ এদিকে সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গি কিট ফুরিয়ে গেলে যথা সময়ে যোগান পেতে বিলম্ব হচ্ছে।কিটের অভাবে রোগীদের রক্ত পরীক্ষার কাজ ব্যাহত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে কলকাতা মেডিকেল কলেজ, আর জি কর মেডিকেল কলেজ, উত্তর বঙ্গ সহ অনেক সরকারি হাসপাতালে।সঠিক সময়ে কিট ফুরিয়ে যাওয়ার কথা স্বাস্থ্যভবন কে জানানোর পরও কিট পাঠাতে দেরী কেন? কিটের দামও স্বল্প এবং সহজলভ্য,তবুও এই সমস্যা ঘটে চলাটাকে কি ইচ্ছাকৃত বিলম্ব বলা যায় না?কারণ কিট থাকলে বেশি সংখ্যায় পরীক্ষা করা যাবে,আর বেশী আক্রান্তের সংখ্যাও ধরা পরবে।সরকারকে সমস্যার গুরুত্ব স্বীকার করে নিতে হবে।তাই কি এই মন্থরগতি? কিন্তু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ডাক্তারদেরকে যেখানে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই মানতে নারাজ যে ডেঙ্গিতে মৃত্যু হচ্ছে না,হচ্ছে অজানা জ্বরে,তাই রক্তে NS 1 পজিটিভ এবং অন্যান্য লক্ষণ থাকলেও মৃত্ত্যুর কারণ হিসাবে ডেঙ্গিকে দোষারোপ করতে ভয় পাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।যদি সত্যিই কোন অজানা জ্বরের আবির্ভাব ঘটে তাহলে সরকারের উচিৎ  অতিশীঘ্র এই অজানা জ্বরের কারণ ও চিকিৎসা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা।সঠিক নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণার মাধ্যমে রোগের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করাও জরুরী। কোন এলাকায় যদি খুব কম সময়ের মধ্যে একটি রোগে বেশ কিছু মানুষ মারা যায় এবং রোগটা যদি অজানা হয় তাহলে রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তরের উচিৎ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যা মন্ত্রকের সাহায্য চাওয়া।কিন্তু 'অজানা' জ্বরের রহস্য সন্ধানে সরকার এখনও তাদের সাহায্য নেয়নি বলে অভিযোগ।অথচ কেন্দ্রীয় সূত্রে জানানো হয় রাজ্য সরকার এবছর ডেঙ্গি সংক্রমনের সর্বশেষ যে তালিকা পাঠিয়েছে সেটা তৈরি হয়েছে ৪ অক্টবারে।অর্থাৎ পরবর্তী একমাসে কোন রিপোর্ট যায়নি কেন্দ্রে।কেন এই গড়ি-মসি সরকারের??

          সম্প্রতি ভারত সহ অন্নান্য দেশগুলিতে ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে পদ্ধতিগত ত্রুটিকেই প্রাথমিক কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।ডেঙ্গি মোকাবিলায় জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।ডেঙ্গির মশা এডিস ইজিপ্টাই প্লাস্টিকের চায়ের কাপ,ডাবের খোলা,পরিষ্কার জমা জলে সহজে বংশবিস্তার করে।ডেঙ্গি ঠেকানোর সবথেকে ভাল পদ্ধতি হল খোলা পাত্রে জল জমতে না দেওয়া।তার জন্য বাড়ির আশেপাশে নিয়মিত পরিষ্কার  রাখা দরকার।শহর এলাকায় এই কাজটা করে পুরসভার জঞ্জাল সাফাই বিভাগ।কিন্তু আশ্চার্যজনক ভাবে ডেঙ্গি মৃত্ত্যু দায় নিতে হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগকেই।অর্থাৎ ডেঙ্গির চিকিৎসার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।কিন্তু দুঃখের বিষয় ডেঙ্গির জন্য নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই।রোগের উপসর্গ দেখে চিকিৎসা করা হয়।তাই ডেঙ্গি মৃত্ত্যু ঠেকাতে চিকিৎসার উপর গুরুত্ব না দিয়ে মশার বংশবিস্তার রোধের উপর নজর দেওয়া উচিৎ।'প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর' অর্থাৎ রোগের চিকিৎসার থেকেও রোগ প্রতিরোধ অনেক বেশি কার্যকরী।ডেঙ্গি প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হল মশার কামড়ের হাত থেকে দূরে থাকা এবং বংশবিস্তার রোধ করা।বিদেশে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রনের মূল দায়িত্বে থাকেন পেশাদার এন্টামোলজিস্টরা অথচ বাংলায় এন্টামোলজিস্টের সংখ্যা খুবই  নগন্য।ফলে মৃত্ত্যুর দায়ভার নিতে হচ্ছে চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যবিভাগ কেই। সরকারের উচিৎ আরও বেশি এন্টামোলজিস্ট নিয়োগ করা এবং বিভিন্ন বিভাগ যেমন স্বাস্থ্য,জঞ্জাল সাফাই,বিল্ডিং নিকাশি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।এতো গেল শাসক দলের নজির। 
এবার দেখা যাক বিরোধী দলগুলির কার্যকলাপ।আসলে রাজনীতি মানেই হল জনপ্রিয়তা আর সে জন্যই তারা মৃত্ত্যু নিয়ে আন্দোলনের নামে জনপ্রিয়তার রাজনীতি করছে।কোন রোগ যখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তখন তার প্রতিরোধে ও প্রতিকারে সকলের ঝাঁপিয়ে পড়া উচিৎ।কিন্তু তা না করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক তৈরী করা হচ্ছে।সরকারের ব্যার্থতা খুঁজে বের করে তার সমালোচনা করাই যেন মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।এটা ভাবা উচিৎ যে রোগ ছড়ানোর জন্য কোন সরকার বা কোন রাজনৈতিক দল দায়ী হতে পারেনা।আজ এই পরিস্থিতির জন্য আমরাই দায়ী। 
আসল সমস্যা আমাদের পরিবেশ।একটা স্বচ্ছ,আবর্জনা মুক্ত পরিবেশ যে সু-স্বাস্থ্যের রূপকার সে ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা।সরকার বা পুরসভা সব কাজ করে দিতে পারেনা কখনও।তার পাশাপাশি প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা,সতর্কতা।মশার বংশবিস্তারের আদর্শ পরিবেশ আমরাই তৈরী করে দিচ্ছি আমাদের অসর্তকতা ও অসচেতনতার মধ্য দিয়ে।বিরোধী দলগুলি সরকারের সমালোচনা,বিরোধীতা না করে এইসব বিষয়ে নির্দিষ্ট কর্মসুচি তৈরী করা উচিৎ।দলবদ্ধ ভাবে পাড়ায় পাড়ায় সাফাই অভিযান করা,ডেঙ্গি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা.লিফলেট,পোস্টার,মিডিয়ার মাধ্যমে রোগের লক্ষণ ও নিরাময়ের উপায়, কি কি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ এইসব বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরী।রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে রক্তের সঠিক জোগান দেওয়া সকলের কর্তব্য।অর্থাৎ বিপদের সময় খামোকা বিতর্ক,সমালোচনা না করে যদি সবাই একজোট হয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করা যায় তাহলেই একটা সুষ্ঠ পরিবেশ উপহার দেওয়া যায়।সরকারের ব্যার্থতা নিয়ে সমালোচনা করার আরও অনেক সময় রয়েছে।
Share on Google Plus Share on Whatsapp



0 comments:

Post a Comment