ফারুক আব্দুল্লাহ
‘ভূত’
শব্দটি আমাদের সবার কাছেই ভীষণ পরিচিত। আমরা অনেকেই ভূত না দেখেও
ভূতের প্রতি ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা নিয়ে চলি।আবার অনেকেই আমরা পুরো ব্যাপারটিকেই
অস্বীকার করে উড়িয়ে দেই। আমাদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজের চোখে ভূত না
দেখেও শুধু অন্যের কথায় বিশ্বাস করে ভয় পাই।আবার কেও ভূত দেখেও যুক্তি খুজে ভয় না
পাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।সত্যই
ভূত রয়েছে কিনা তা
বিতর্কের বিষয় কিন্তু আমরা আনেকেই যে মনের ভেতর ভূত ও তার আজানা ভয় নিয়ে চলি সে কথা বোধহয় না মেনে উপায় নেই।
ভূত নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই,ভূতকে ভয়
পেলেও আমরা ভূত এর গল্প পড়তে ভালবাসি,ভূতের সিরিয়াল থেকে সিনেমা কোন কিছু দেখা
থেকে আমরা বিরত থাকিনা।ভূত সম্পর্কে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা আমাদের মন কাড়ে।
ভূত সম্পর্কে নানারকম কাহিনী,নানারকম বিশ্বাস
সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে,আমাদের
দেশও এর ব্যাতিক্রম নয়। আমাদের দেশেও এমন আনেক ভৌতিক ঘটনা ও অভিজ্ঞতার কথা শোনা
যায়।যেগুলি শুনলে এখনও গা ছমছম করে ওঠে।
মুর্শিদাবাদের
জেলা শহর বহরমপুরের নাম আমরা অনেকেই জানি।এটি একটি প্রাচীন শহর।১৭৫৭ সালের
পলাশীর যুদ্ধের পর বহরমপুরেই ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর সেনাবাহিনীর ঘাটি গড়ে
উঠেছিল ছিল।শুধু তাই নয় এই সেনা ব্যারাকেই প্রথম সিপাহী
বিদ্রোহের(মহাবিদ্রোহ)সূচনা হয়েছিলো ১৮৫৭ সালে।অন্যা্ন্য পুরনো শহরের মত এই শহরেরও
কিছু ভূতের কাহিনী প্রচলিত আছে।বহরমপুরের এই ভূত ‘ল্যাংড়া সাহেব এর ভূত’ বলে পরিচিত ছিল।এই
ল্যাংড়া সাহেব নাকি ভাগীরথী নদীর তীরে একটি লাল রঙের বাড়িতে বাস করতেন।তিনি পেশায়
ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর একজন আর্মি অফিসার। তিনি তার নিষ্ঠুর আচরণ ও বদমেজাজের জন্য
কুক্ষাত ছিলেন।১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে দেশীয় সেপাইদের হাতে তার
মৃত্যু ঘটে এবং মৃত্যুর পর শুরু হয়
ল্যাংড়া সাহেবের ভুতের আতঙ্ক।নদীর ধারে যেখানে তার বাড়ি ছিল সেই এলাকাই এখনও নাকি
সাহেবের ভূত ঘুরে বেড়াই।কখনও কোন নির্জন দুপুরে সাহেবের বাড়ি সাংলগ্ন এলাকায়
আনেকেই ল্যাংড়া সাহেবের দেখা পান এবং তার সাথে কারো দেখা হলে তিনি নাকি সেই বাক্তিকে ভীষণ বকাবকি করেন এবং উচ্চস্বরে জানান যে ‘সবার বিরুদ্ধে বাবস্থা
নেওয়া হবে’।
কলকাতাতেও
বহু ভৌতিক জায়গা রয়েছে।এই সমস্ত জয়গা গুলির মধ্যে অন্যতম হল কলকাতা বন্দর এলাকা।কোন এক সময় এই এলাকাটি
ছিল অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্র সম্পত্তি।ব্রিটিশরা অযোধ্যার নবাবের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে কলকাতায় নির্বাসিত করা
হলে কলকাতার
এই বন্দর এলাকায় মেটীয়াবুরুজে নবাব বসবাস
করতে শুরু করেন,কিন্তু ইংরেজরা নবাব এর সাথে কখনই ভাল আচরণ করেননি।নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর মৃত্যুর পর তার ভূত এখনও নাকি এই বন্দর এলাকায় ঘুরে বেড়ায়,অনেকেই
দাবি করেন যে তারা নবাবের ভূত কে দেখেছেন।শুধু তাই নয়,অনেকে নবাব ওয়াজেদ আলির
প্রিয় গানও হঠাৎ করেই বেজে উঠতে শুনেছেন কিন্তু সে গান একসাথে সবার
কানে এসে পৌছয়নি।
কলকাতার
আলিপুরের হেস্টিংস হাউস যেখানে কোন এক সময় গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস বসবাস করতেন,
সেটি বর্তমানে একটি গার্লস কলেজে রুপান্তরিত হয়েছে।এই বাড়ি সম্পর্কে যে ভৌতিক গল্প
রয়েছে তা হল এখনও নাকি আনেকেই ওয়ারেন
হেস্টিংসের ভূত দেখতে পান।রাতের বেলাই ঘোড়ায় চড়ে তিনি এই বাড়িতে প্রবেশ করেন এবং
অফিস এ গিয়ে নাকি বিভিন্ন কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করেন।
কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে জাদুঘর দেখেনি এমন
মানুষ বোধহয় খুব কম পাওয়া যাবে।কলকাতা
জাদুঘরের বর্তমান বিল্ডিংটি প্রায় কয়েকশো বছরের পুরনো। এবং সবচেয়ে মজার কথা এই
জাদুঘরও একটি ভৌতিক যায়গা যদিও জাদুঘর করতিপক্ষ
এটা মানতে চাইনা।এই জাদুঘরে নাকি এখনও নানা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ ভেসে আসে,মাঝে
মাঝেই নাকি ঝুমুরের আওয়াজ শোনাযায় বিভিন্ন গ্যালারী থেকে।
প্রাচীন জেলা গুলির মধ্যে অন্যতম জেলা হলো
মুর্শিদাবাদ।এই জেলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস,শুধু ইতিহাসই নয় এই পুরনো
জেলায় রয়েছে আনেক ভৌতিক ঘটনাও বাংলার নবাব সারফারাজ খান ১৭৪০ সালে একটি
মসজিদ তৈরি করতে শুরু করেছিলেন কিন্তু তিনি এই মসজিদটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি কারন তার পূর্বেই তিনি গিরিয়ার
যুদ্ধে মারা যান।এ বিষয়ে একটি কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে যে তিনি নাকি কোন
বন্ধুকের গুলিতে মারা যাননি,তিনি মারা গেছিলেন বজ্রপাতে।এবং আশ্চর্যের বিষয় উনি
যখন মারা যান তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নির্মীয়মাণ মসজিদে অনর্গল বজ্রপাত হতে
থাকে এবং সেই কারনেই মসজিদের কাজ বন্ধ হয়ে যায় যা আজ অবধিও সম্পূর্ণ হয়নি।তাই
মসজিদটি ‘ফুটি
মসজিদ’(অসম্পূর্ণ মসজিদ)নামেই পরিচিত। এই মসজিদ নিয়ে আর একটি ভৌতিক কাহিনী প্রচলিত
রয়েছে সেটি হল মসজিদটি নাকি রাত্রি বেলায়
তৈরি করা করা হয়েছিল।দেখা যেত যে রাত্রি বেলায় প্রচুর মিস্ত্রি কাজ করছে কিন্তু কাজের পর
মিস্ত্রীদের বেতন দেবার সময় কাওকেই আর দেখাযেতনা
সবাই উধাও হয়ে যেত,এবং প্রতি রাতেই একি ঘটনা বারবার ঘটত তাই এই ভৌতিক ঘটনাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মসজিদ এর
কাজ শেষ করা যায়নি।মসজিদটি এখনও ওই ভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় আনাদরে পড়ে রয়েছে।
মুর্শিদাবাদের
মতিঝিলের সাথেও এইরকম একটি ভৌতিক ঘটনা
জড়িয়ে রয়েছে।মতিঝিল ছিল নবাব আলীবর্দি
খানের মেয়ে ঘসেটি বেগম এর এলাকা।নবাব সিরাজ মতিঝিল আক্রমণ করলে সিরাজের হাত থেকে
তার সমস্ত ধন সম্পদ,সোনা দানা,মনি মুক্তা,হীরে জহরত, সব কিছু রক্ষা করার জন্য ঘসেটি বেগম তার প্রাসাদ থেকে কিছুটা দূরে একটি
কুঠুরিবিহীন ঘরের মেঝেতে তার এই সব সম্পদ পুতে
রেখে গিয়েছিলেন বলে কাহিনী প্রচলিত রয়েছে,কিন্তু পরবর্তীকালে
তার সেই সম্পত্তির হদিশ কেওই আজ অবধি পাইনি।তবে ইংরেজ আমলে কিছু ইংরেজ কর্মচারী
চেস্টা করেছিলেন সেই ঘর খুড়ে সম্পত্তি উদ্ধার করতে কিন্তু যারা সেই ঘর খোঁড়ার কাজে
নিজুক্ত ছিল প্রত্যেকেই মুখে রক্ত উঠে সেখানেই মারা যায়,ফলে এই রহস্যের আজ অবধি
কোন কিনারা করা সম্ভব হয়নি।
মুর্শিদাবাদ মানেই হাজারদুয়ারির কথা আমাদের
মাথায় আগে আসে।হাজারদুয়ারি দেখেনি পশ্চিমবাংলায়
এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম।এই হাজারদুয়ারির নিয়েও আনেক ভৌতিক কথা শোনা যায় যদিও
করতিপক্ষের লোকেরা একথা অস্বীকার করেন। হাজারদুয়ারি নাকি রাত্রিবেলায় জীবন্ত হয়ে ওঠে, নানা ধরনের ঝুমুরের আওয়াজ শোনা যায়
সেখানে,ভেতরের তৈলচিত্র গুলোও মূর্ত হয়ে ওঠে রাতে,সেই সাথে শোনা যায় ফিসফিস করে কথা
বলার আওয়াজও। এই ঘটনায় ভীত হয়ে আনেক নাইট গার্ড তাদের কাজে
ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে বলে শোনা যায়।হাজারদুয়ারির
ভৌতিক কাহিনী নিয়ে প্রায় ৮ বছর আগে পশ্চিমবাংলার এক নামী
দৈনিকে ধারাবাহিক লেখাও প্রকাশিত হয়েছিলো।
হাজারদুয়ারির সামনে যে মাঠটি রয়েছে সেখানেও নাকি
পূর্ণিমার রাতে মাঝে মাঝে একজন বাক্তিকে দেখা যায় যিনি ঘড়ার পিঠে চড়ে মাঠ
প্রদক্ষিণ করেন,তার হাতে থাকে একটি
উন্মুক্ত তরবারি এবং তার পরনে থাকে ঝলমলে
পোশাক।তবে তাকে শুধুমাত্র ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড় থেকেই দেখা যায়।
রাজস্থানের
বহু স্থানেই ভৌতিক ঘটনা ছড়িয়ে রয়েছে। রাজস্থানের ভানগড় দূর্গের কথা ও তার ভৌতিক
কাহিনী আমরা আনেকেই জানি কিন্তু ভানগড় ছাড়াও আরও কিছু ভৌতিক জায়গা রাজস্থানে রয়েছে
এর মধ্যে অন্যতম হল বিরিজ রাজভবন প্রাসাদ।এই প্রাসাদ সংলগ্ন এলাকায় ১৮৫৭ সালে এক
ব্রিটিশ সৈন মারা যায় এবং তিনি ভূত হয়ে সেই প্রাসাদেই বসবাস করতে থাকেন।এই ভূতটি সাধারনত কারো কোন ক্ষতি করে না বটে তবে একদিন শুধুমাত্র প্রাসাদের রক্ষিকে চড় মেরেছিল
বলে কথিত আছে।
রাজস্থানের আর একটি ভৌতিক এলাকা হল রাজস্থানের
কুলধারা গ্রাম।এই গ্রামের যে ঘটনা সেটি ভীষণ অবাক করার মতই,এই কুলধারা গ্রামটিতে
প্রায় ৭০০ বছর ধরে মানুষ বসবাস করতো কিন্তু ১৮২৫ সালে এক রাতে হঠাৎ করেই গ্রামের সমস্ত মানুষ অদৃশ্য হয়ে যায়।কোথাও তাদের কোন খোজ পাওয়া যায়না,তবে এর কারন হিসেবে আনেকে বলেন যে এলাকার
শাসক সেলিম সিং কুলধারা গ্রামের প্রধানের মেয়ে কে বিয়ের প্রস্তাব দেয় কিন্তু এই বিয়েতে প্রধানের কোন
ইচ্ছা ছিল না,ফলে সেলিম সিং গোটা গ্রামকে হুমকি দেয় যে যদি তার সাথে প্রধানের
মেয়ের বিয়ে দেওয়া না হয় তবে গ্রামে সবার খাজনা দ্বিগুণ করে দেয়া হবে,হয়ত এই জন্যই
কোন এক রাতে সমস্ত গ্রামের মানুষ গ্রাম ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে গেছে।কিন্তু এই
ঘটনাকে সবাই ভৌতিক বলেই মনে করে এবং কেওই এই গ্রামে বসবাস করার সাহস পাইনা,আনেকেই
এই গ্রামকে অভিশপ্ত বলে মনে করে।
ভূতের
অস্তিত্ব থাক কিম্বা না থাক তবু ভূতকে নিয়ে মাতামাতি থাকবেই,এবং ভূতের প্রতি আমাদের ভয়ের কারনেই চিরকাল তাদের অস্তিত্ব
আমাদের মনের মধ্যে বেচে থাকবে।
তথ্যসূত্র
1)www.hellotravel.com
2) fearandyou.in
3) www.grabhhouse.com
4) www.zeenews.india.com
5) www.indiatimes.com
6)musnud of murshidabad by purna ch majumder
0 comments:
Post a Comment