ইতিহাসে গণহত্যা : জাতিগত বিদ্বেষ নাকি রাজনীতি?

কাজী হাবিব হাসান  : মানব সভ্যতার ইতিহাস বড় বিচিত্র, সূচনার প্রথমে আমরা বন্য প্রানীর সঙ্গে লড়াই করেছি আদিম গুহাবাসী থেকে পর্যায়ক্রমে কৃষি অথর্নীতির বিকাশ গোষ্ঠীর শাসনের মধ্য দিয়ে আমরা আজ আধুনিক রাষ্ট ব্যবস্থায় উন্নতি অবশ্য এই উন্নয়ন সারা বিশ্বে একই সময় ঘটেনিএই পর্যায়েআসার প্রথম থেকেই পৃথিবীতে ঘটেছে অনেক রক্তপাত, যুদ্ধ,পররাজ্য গ্রাস আধুনিক কালে আমরা দেখেছি নয়া উপনিবেশবাদের ভয়াবহ চিত্রমানবতাবাদের আদর্শকেধুলিসাৎ করে ঘটে গেছে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ তবে আমাদের ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধ বিবাদ ঘটলেও তার নিষ্পত্তির অনেক চেষ্টা দেখা গেছে

এই আধুনিক পর্যায়ে উন্নতি হতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে সৃষ্টি হয়েছে নানান ধর্ম,জাতি গোষ্ঠী, সম্পদায়আর যখনই এই সম্পদায় গুলির মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে,তখনই ঘটেছে গণহত্যা এখন প্রশ্ন হল গণহত্যা কি বা কাকে বলব? গণহত্যা হল একটি শত্তিশালী দলের মাধ্যমে সুপরিকল্পিত ভাবে অপর বা দূর্বল দলের হত্যাযজ্ঞযুদ্ধ ক্ষেত্রে সম্মুখ সমরে যুদ্ধে মারা যাওয়াকে আমরা গণহত্যা বলতে পারিনাকেননা যুদ্ধ শত্রু পক্ষকে হত্যা করার বৈধ অধিকার দেয়কিন্তু নিরস্ত্র সাধারণ জনগনকে যদি আবেগে বশীভূত হয়ে হত্যা করে তাকে গণহত্যা  বলা হয়আসলে ক্ষমতাহীন শ্রেনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী দলের বল দেখানোর কৌশলই গণহত্যা তবে বর্তমানেগণহত্যা নানান রুপ ধারণ করেছেবিংশ শতকে উগ্র জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে জাতির উন্নতির স্বপ্ন দেখা হয়েছিল,ঘটল তার বিপরীত দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধঅন্যদিকে আজ সন্ত্রাসবাদ তার বিষ দাঁত করে সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেআজ রাজা,সম্রাট বা হিটলারের মত রাষ্ট্র নায়ক নেই ঠিকই,কিন্তু ইতিহাস গনহত্যার কাহিনী  বর্ননা  করছেপ্রসঙ্গত উল্লেখ্য গণহত্যা নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত বিতর্কীত স্পর্শকাতরবিষয়,নানা মুনির নানা মতঅনেক সময় দেখা গেছে একটি নিপীড়িত জাতি পরবর্তী কালে শক্তিশালী হয়ে প্রতিশোধ নিলে,সেখানেও দেখা যায় গণহত্যা এই ধরনের নজির ভারত তথা বিশ্ব ইতিহাসে অভাব নেই

ভারতের ইতিহাসে গনহত্যার ইতিহাস প্রাচীন যুগ থেকে আজও চলমান নানা সময়ে এদেশের উপর নেমে এসেছে বিদেশি আক্রমণ, আর তখনই ঘটেছে গণহত্যা বিদেশি জাতিগুলি নিয়ে এসেছিল নিজেদের সংস্কৃতিঅন্যদিকে দেশীয় রাজ্য,গোষ্ঠী বিভিন্ন ধর্মীয়সম্পদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছে কালে কালেযার অনিবার্য পরিণাম হল হত্যালিলা চলেছে ব্যাপক ভাবেপ্রাচীর ভারতে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল কলিঙ্গ যুদ্ধএই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আধুনিক কালের অনেক যুদ্ধের চেয়েও ছিল অনেক বেশিচন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বিন্দুসার কলিঙ্গ জয় করতে ব্যার্থ হনসম্রাট অশোক তার শাসনের অষ্টম বছরে ২৮১ খ্রীষ্ট -পূর্বাব্দে বর্তমানে  উড়িষ্যার ভূবনেশ্বনের নিকট কলিঙ্গ যুদ্ধ হয়এই যুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু হয়যা ছিল তখনকার দিনে কলিঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক যুদ্ধ জয়ের পর কলিঙ্গে ব্যাপক লুঠ ধ্বংসলীলা চালানো হয়যুদ্ধের ভয়াবহতায় চণ্ডাশোক অশোক ধর্মাশোকে পরিণত হয়
সপ্তম শতকের শৈব ধারা বিবরণী থেকে জানা যায়,মাদুরাই গণহত্যা সম্পর্কেপাণ্ডরাজ কুন পাণ্ড(Koon Pandiyan) প্রথম জীবনে শৈব ধর্ম থেকে জৈন ধর্মের দিক্ষানেনকিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে তিনি পুনরায় শৈব ধর্মে ফিরে যানরাণী শৈব পণ্ডিত সোমনাথমের চক্রান্তে তিনি তামিল জৈন পন্ডিতদের শৈব ধর্ম গ্রহনের আদেশ জারি করেনসেই সময় দক্ষিণ ভারতে জৈন ধর্মের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গেএই পরিস্থিতিতে জৈন পন্ডিতরা রাজার আদেশ মানতে অস্বীকার করলে রাজা পন্ডিতদের হত্যার আদেশ দেনফলস্বরুপ সেনারা প্রায় আট হাজার জৈনকে তীর বিদ্ধ করে হত্যা করেন

মধ্যযুগ ভারতের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ কর,এই সময় কালে এদেশে বিদেশি মুসলিম আক্রমণ আধিপত্য বিস্তারের সূচনা হয়নতুন আগত ইসলামধর্মেরসঙ্গে তাই সংঘাত ছিল অনিবার্য ১০০০-১৫০০ খ্রীঃ মধ্যে মুসলিম আক্রমণ ও সংঘাতের ফলে এদেশীয় জনগনের প্রায় আশি মিলিয়ন গনহত্যার স্বীকার হনসুলতান মামুদের ১৭ বার ভারত আক্রমণ,মন্দির ধ্বংস লুঠতরাজ এদেশীয়দের প্রতি ধর্মীয়বিদ্বেষে তিনি প্রায় পনেরোহাজার নরনারীকে হত্যা করেনঅন্যদিকে ভারতে সুলতানি শাসনের বীজ বপন করা হয়মুহাম্মদ ঘুরির আক্রমনের মধ্যে দিয়েতাতে বহু সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লং  -এর ভারত আক্রমণ,তিনি তার সৈন্যদের অবাধে বিশেষ করে হিন্দুদের হত্যার আদেশ দেনফলস্বরুপ কয়েক হাজার নিরাপরাধ জনগন এই হত্যাযজ্ঞের স্বীকার হন

লোদী বংশের পতনের পর ভারতে শক্তিশালী জাতি হিসাবে রাজপুতরা নিজেদের ক্ষমতা বিস্তার করতে সমর্থ হন১৫২৬ বাবর যে মোঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করে তা ধাক্কা খায় শেরশাহের হাতেঅতঃপর ১৫৫৬ পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে সম্রাট আকবর জয়লাভের মধ্যদিয়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সমর্থহনসম্রাট আকবর প্রবল বিক্রমে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেনযার আবসম্ভাবী পরিণতি মোঘল-রাজপুত বিরোধ কয়েকটি রাজপুত রাজ্য আকবরের বশ্যতা স্বীকার করলেও মহারানা প্রতাপ সিংহ তা অস্বীকার করেফলস্বরুপ ১৫৬৭ সালে আকবর চিতোর দূর্গ আক্রমণ করেনচারমাসঅবরুদ্ধ থাকার পর ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৫৬৮ মোগল সৈন্যরা দূর্গটি জয় করেনপ্রায় আটহাজার রাজপুত সেনাকে হত্যা করা হয় বেশির ভাগ  মহিলা জহরব্রত পালন করে নিজেদের সন্মান রক্ষা করেচিতোর দূর্গে যে হত্যালীলা চলে তাতে সর্বমোট প্রায় পঁচিশ হাজার জনসাধারনের মৃত্যু হয়কিন্তু মহারানা প্রতাপ সিংহ নিজের জীবিত কালে মোঘল আধিপত্য মেনে নেননি তিনি নানা ভাবে মোঘলদের উপর আক্রমণ চালাতেন

                     ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দক্ষিণ ভারতে মারাঠা শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়কিন্তু তাদের সেই সুদিন বেশিদিন স্থায়ী হল নাআহম্মদ শাহ আবদালির ভারত আক্রমণ তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ মারাঠা সাম্রাজ্যের ব্যাপক পরিমাণ ক্ষতি করে১৭৬১সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি আহম্মদ শাহ আবদালি তার দুই দোসরআফগান রোহিলা সুজা-উদ-দৌলার যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মারাঠাদের পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়এই যুদ্ধে বাইশ হাজার মারাঠা সৈন্যের মৃত্যু হয়যুদ্ধ জয়ের পর আফগান বাহিনী যুদ্ধ বন্দি সৈন্য সাধারণ নাগরিকের রক্তে পানিপথের পথ ভাসিয়ে দেনএকটি বিবরণী থেকে জানা যায়১৪ বছরের বড় বালকদের তাদের পরিবারের সামনে শিরচ্ছেদ করা হয়যুদ্ধের পরেরদিন আফগান বাহিনী পাশ্ববর্তী অঞ্চলের অমুসলমান তথা হিন্দু জনগনের উপর ব্যাপক উৎপীড়ন হত্যালীলাচালায়ও প্রায় চল্লিশহাজার মারাঠা নাগরিক মৃত্যু মুখে পতিত হয় হাজার হাজার মারাঠা মহিলা আফগান সৈন্যদের হাতে বন্দি হওয়ার চেয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যুকে শ্রেয় বলে মনে করেন

পর্তুগীজদের ভারত আগমন ও ম্যাঙ্গালোরের বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য বহু সংখ্যক বিদেশী সেখানে  বসবাস করতে শুরু করেহায়দ্রাবাদের সুলতান হায়দার আলির সময় কালে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা তার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেতাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ষাটহাজারসুলতানের সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানির সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে তা থেকে যুদ্ধ,ফলে সুলতান বিদেশীদের প্রতি রুষ্ঠ হতে থাকেনহায়দারের মৃত্যুর পর টিপু সুলতান সিংহাসনে বসলে পরিস্থিতি ঘোরাল হয়ে ওঠেঅন্যদিকে ম্যাঙ্গালোরের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সঙ্গে কোম্পানির সখ্যতা বাড়তে থাকেএমতাবস্থায় ১৭৮৪খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জানুয়ারি টিপু একটি ফরমান জারি করে ম্যাঙ্গালোরের খ্রিষ্টানদের সমস্ত সম্পতি বাজেয়াপ্ত করেন ফলে তারা শ্রীরঙ্গপত্তনামে যেতে বাধ্য হনএই বিপদ সংকুল যাত্রায় কুঁড়ি হাজার ব্যক্তির মৃত্যু হয়এছাড়া বহু সংখ্যক ব্যক্তিকে ধর্মান্তকরন,লুণ্ঠন ও অত্যাচারের স্বীকার হতে হয়শেষ পর্যন্ত মাত্র কুঁড়ি হাজারব্যক্তি বিধ্বস্ত হয়ে শ্রীরঙ্গপত্তনামে পৌঁছাতে পারে

                  ১৮৫৭সালের মহাবিদ্রোহের সময় কালে কানপুরে কয়েকশো ব্রিটিশ শিশু মহিলাকে বিবিঘর নামক বাড়ীতে হত্যা করা হয়যা ইতিহাসে বিবিঘর হত্যাকান্ড নামে পরিচিত মেজর জেনারেল স্যার হুইলার সেই সময় কানপুরের কামান্ডার ছিলেন শহরে মহাবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় নেতা নানা সাহেব বিদ্রোহীদের পক্ষ নেনহুইলার কয়েক সপ্তাহ পরে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়,যদি নানা শিশু মহিলাদের রক্ষার দায়িত্ব নেন নানা তাতে রাজিও হনএমতাবস্থায় ১৮৫৭ সালের ২৭ শে জুন সতি চৌরা ঘাট থেকে ব্রিটিশরা এলাহাবাদের উদ্দেশ্য যাত্রা করেনকিন্তু পথমধ্যে বিদ্রোহী জনতা তাদের নৌকার উপর আক্রমণ চালিয়ে হুইলার সহ বেশিরভাগ ব্রিটিশকে হত্যা করেযারা বেঁচে যান তাদের কানপুরের বিবিঘরে রাখা হয়এছাড়া নানা সাহেব আরও কিছু যুদ্ধবন্দি শিশু মহিলা সহ ২০০ জনকে বিবিঘরে বন্দি করে রাখেনজেনারেল হেনরি হ্যাভলকের নেতৃত্বে বিরাট বাহিনী কানপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেননানা সাহেব প্রতিরোধ যুদ্ধ বন্দিদের নিয়েদরকষাকষি করলেও তা বিফলে যায়শেষ পর্যন্ত ১৫ জুলাই বিবিঘরে বন্দি শিশু মহিলাদের নৃশংসভাবে  হত্যা করা হয়

মহাবিদ্রোহের অন্যতম ঝটিকা কেন্দ্র ছিল ঝাঁসিলর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির কারনেঝাঁসি তার সার্বভৌমত্ব হারায়কাজেই ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই মহাবিদ্রোহে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনযুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনী তাকে আত্মসমর্পণ করতে বললেতিনি অস্বীকার করেন যুদ্ধের ডাক দেনযুদ্ধে তিনি নিহত হনযুদ্ধ যুদ্ধ পরবর্তীকালে কোম্পানি সেনাবাহিনী ঝাঁসির উপর ব্যাপক হত্যালিলা চালায়প্রায় পাঁচ হাজার নারি-পুরুষও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়যা ঝাঁসি গণহত্যা নামে খ্যাত এই হত্যাযজ্ঞেরমুল হোতা ছিলেন ব্রিটিশ বাহিনীর স্যার হুগ রোজ

                 ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ইতিহাসে অমৃতসর হত্যাকান্ড নামেও পরিচিত সেই সময় দেশ জুড়ে চলছিল অসহযোগ আন্দোলন, তাই ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় আন্দোলনের উপর তীক্ষ দৃষ্টি রাখে১৩ এপ্রিল জেনারেল ডায়ার পাঞ্জাবে সমস্ত সভা সমিতি নিষিদ্ধ করে কার্ফু জারি করেনকিন্তু এই দিনটি ছিল বৈশাখী উৎসবের দিন,এটি ছিল পাঞ্জাবের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক উৎসব ফলে জনতা সরকারি আদেশ অমান্য করে জালিয়ানওয়ালাবাগে মিলিত হন১০ ফুট উচু প্রাচীরে ঘেরা জায়গাটি প্রায় - একর,মোট ৫টি প্রধান ফটক ছিলএমতাবস্থায় জেনারেল ডায়ার বিকেল .৩০ মিনিটে ৫০ জন গোর্খা সেনা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন১৫ হাজার জনতা সমবেত বাগের মুল ফটক অবরুদ্ধ করে তিনি বিনা প্ররোচনায় ১০ মিনিট ধরে ১৬৫০ রাউন্ড গুলি চালাননিরস্ত্র জনতার পালানোর কোন জায়গা ছিল নাফলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই হত্যাযজ্ঞে একহাজার মানুষের মৃত্যু হয় ১৫০০ জন আহত হনএই ঘটনার প্রতিবাদেসারা দেশ ফেটে পড়েপাঞ্জাবে রেওলাইন,টেলিগ্রাফ প্রচুর সরকারি ভবন ধ্বংস করা হয়এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট হুড উপাধি ত্যাগ করেন

১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে সারা ভারত জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়পেশোয়ারে(বর্তমান পাকিস্থান) খুদা--খিদমদগার সংগঠনের নেতা খান আব্দুল গফফার খানের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে২৩ শে এপ্রিল তিনি কিশা খানি বাজারে( The Storyteller Market) ভাষন দিলে ইংরেজ বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করেএতে ক্ষিপ্ত হয়ে জনতা খোদা--খিদমদগার দলের আন্দোলনে যোগ দেনবেশিরভাগ নেতা বন্দি হলে জনতা কিশা খানি বাজারে সমবেত হনসেখানে ব্রিটিশ সেন্য উপস্থিত হলে জনতা তাদের উপর ইট বৃষ্টি করেক্ষিপ্ত হয়ে বাহিনী দুটি গাড়ী দ্রুত গতিতে জনতার উপর চালিয়ে দেনতাতে বেশ কিছু জনতার মৃত্যু ঘটে সেনারা সেখান থেকে জনতাকে চলে যেতে বললে তারা তা অস্বীকার করেফলে সেনাদল নিরস্ত্র জনতার উপর মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়ে ৪০০ আন্দোলনকারীকে হত্যা করেএই ঘটনা  কিশা খানি বাজার হত্যাকান্ড নামে পরিচিত

              ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চরম অবমাননা দেখা যায়এই হত্যাকান্ডে মেতে উঠেছিল এদেশীয় হিন্দু-মুসলমানরা একে অপরের বিরুদ্ধে১১-১৪ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় অল্প কিছু দাঙ্গার পর পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনায় ভরাক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ক্যাবিনেট মিশনের নিযুক্তি  সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারাই ইন্দন জুগিয়ে ব্রিটিশরা পরিস্থিতি আরও শোচনীয় করে তোলেমুসলিম লীগ  দেশ ভাগে সম্মতি জানালেও কংগ্রেস  প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেফলে সংকটের কালো মেঘ দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগ Direct Action Day ডাক দেয়সেই সময় বাংলার জনসংখ্যার সিংহভাগ মুসলিম হলেও কলকাতার চিত্র ছিল অন্যরকম, সেখানে ৬৪% হিন্দু ৩৩% মুসলিমের বাসছিল ফলে কলকাতার জনগণ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে১৬ আগস্ট সকাল থেকেই পরিস্থিতি ছিল থমথমে শুরু হয় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গামাত্র ৭২ ঘন্টার এই দাঙ্গায় হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে একলাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েইতিহাসে এই দিনটি The Week Of The Long Knives নামে খ্যাত
ভারত-পাকিস্থান বিভাজনের পর প্রায় এক হাজার কিলোমিটার ব্যবধানে দুটি পৃথক ভুখন্ড নিয়ে পাকিস্থানের জন্ম হয়সেই সময় পূর্ব পাকিস্থানের(বাংলাদেশ)জনসংখ্যা ছিল ৭৫ মিলিয়ন, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্থানের মাত্র ৫৫ মিলিয়ন কিন্তু পূর্বপাকিস্থানের নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক রুপে গন্য করা হতউর্দূকে রাষ্ট্রীয় ভাষা  করা হলে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্থানের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়কেননা পূর্ব পাকিস্থানের ভাষা ছিল বাংলা এই রকম উত্তেজক পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৭০ এর নির্বাচনে শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেকিন্তু রাষ্ট্রপতি  ইয়াহায়া খাঁন আওয়ামী লীগকে নিসিদ্ধ ঘোষণা করে দেশে জরুরি ব্যবস্থা জারি করেফলে ১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্থানের জনগন দেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তি আন্দোলন শুরু করেনপূর্ব পাকিস্থানের এহেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট ১৯৭১ সালের মার্চ শুরু করেনয় মাস ধরে চলা অপারেশন সার্চলাইট এর মাধ্যমে বাংলাদেশে চলে ব্যাপক গননিধন হত্যা লিলাজাতি ধর্ম নির্বিশেষে ৩০লাখ জনগনকে হত্যা করেদুই-চার লাখ নারী ধর্ষনের স্বীকার হন ৩০ মিলিয়ন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ইউরোপের ইতিহাসে অটোমান ভেঙ্গে পড়ার পর আধুনিক তুরস্ক রাষ্টের জন্ম হয়তুরস্ক সেই সময় সংখ্যালঘু  আর্মেনীয় খ্রিষ্টানদের অঞ্চল থেকে উৎখাত করেবিশ্বের নানা প্রান্তে আদিবাসীরা বিভিন্ন সময় বাস্তুচ্যুত বা গহত্যার স্বীকার হয়েছেআজ পর্যন্ত তারা সুবিচার পাননিকলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পূর্বে সেখানকার আদিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক মিলিয়ন ১৪৯২ সালের পরে উত্তর আমেরিকার সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপীরা অভিযান চালিয়ে তাদের ধ্বংস করেদক্ষিণ আমেরিকায় ফ্রান্সিসকো পিজেরো ইনকাদের নির্মূল করেমেক্সকোতে হারনান কার্টিস  জাতিকে উৎখাত করেনকিন্তু জলবসন্ত তাদের আরও ক্ষতি করে,এই মহামারিটি ইউরোপীয়রা সেখান নিয়ে যায় আদিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়তাদের সভ্যতা, জাতিসত্তা সবই ধ্বংস করা হয়

মাউরি জনগোষ্ঠী হল পলিনিশিয়ান,তারা নিউজিল্যান্ডে প্রায় ৮০০ বছর  ধরে বাস করতে থাকেপ্রায় ৫০০ বছর  আগে মাউরিদেরকয়েকটি দল পাশ্ববর্তী চট্টম দ্বীপে যাত্রা করেএই শান্তিপ্রিয় জাতিটির সমস্যা সৃষ্টি হয় আমেরিকা ইউরোপীয়দের সংস্পর্শ পেলেইউরোপীয় বন্দুক তাদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে ওঠে,ফলে তারা ক্রমশ হিংসাত্ম যুদ্ধ ভাবাপন্ন হয়ে ওঠেতারা নিজেদের জাতিগত বিশুদ্ধতা হারায় ১৮৫০ পরবর্তী মাউরিরা বানিজ্যে অংশ গ্রহণ করতে থাকেএক সময় তারা চট্টম দ্বীপে পৌঁছায় স্বজাতীয়দের নির্বিচারে হত্যা করেযারা বেঁচে যায় তাদের দাসে পরিণত করা হয়এই গননিধন চলতে থাকে প্রায় ৩০ বছর ধরেশেষ পর্যন্ত মাত্র ১৩০ জন বিশুদ্ধ মাউরি বেঁচেছিলঅবশ্য ১৯৩৩ সালে সর্বশেষ বিশুদ্ধ মাউরির মৃত্যু ঘটলে জাতিটির শেষ প্রদীপটি নিভে যায়

মধ্যপ্রাচের কুর্দিরা প্রাচীর ইউরোপীয় জাতি গোষ্ঠীর বংশধর এদের বিস্তৃতি মধ্যপ্রাচের কতিপয় রাষ্টের সীমানা অতিক্রম করেছেইরাকেরপ্রায় ২০% জনগন ছিল কুর্দিএই কুর্দিরা ইরাকের উত্তরদিকে তুরস্ক ইরানের সীমানা বরাবর বসবাস করতে থাকেঐতিহাসিক ভাবেই  ইরাকের সঙ্গে তাদের অনেক আগে থেকেই বিরোধ অব্যাহত ছিল১৯৮০ দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে সাদ্দাম হোসেন অভিযান চালায় মাষ্টার গ্যাস,মেরিন গ্যাস VXনার্ভ গ্যাস ব্যবহার করে পরিকল্পিত ভাবে এক লাখ আশি হাজার কুর্দিজনগনকে হত্যা করা হয়

বিশ্ব-ইতিহাসে যে কয়েকটি নৃশংস গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম আফ্রিকার কঙ্গো হত্যাকান্ডএই গনহত্যার নায়ক ছিলেন বেলজিয়াম রাজ দ্বিতীয় লিওপোন্ডযে বিশাল পরিমাণ মানুষ এই হত্যাযঞ্জের স্বীকার হয়েছিল ইতিহাসে তা বিরল ঔপনিবেশিক লড়ায়ে প্রথম থেকে ইউরোপীয় শক্তিগুলি সক্রিয় থাকলেও বেলজিয়াম  ছিল অনেক পিছিয়ে এশিয়ায় ক্ষমতা বিস্তার করতে না পেরে বেলজিয়াম রাজ আফ্রিকার উপর দৃষ্টি দেনতিনি প্রতারনার ছলে আফ্রিকার কঙ্গো কিনে নেন কঙ্গোর জনগনকে দাসে পরিণত  করেনউল্লেখ্য  একটি দেশের আপামর জন সাধারনকে দাসে পরিণত করার নজির ইতিহাসে বিরলবেলজিয়াম রাজ লিওপোন্ড International African Society নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেতথা কথিত ঔপনিবেশিক শাসনের মেকি আদর্শ মানবকল্যানের আড়ালে দাস ব্যবসা চলতে থাকেতাদের উদ্দেশ্য ছিল কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করালিওপোন্ডর সেনা বাহিনী হতদরিদ্র কঙ্গোবাসীর উপর হাঁতির দাঁত রবারসংগ্রহের সীমা নির্দিষ্ট করে দিততা পূরণ না করতে পারলে চলত অত্যাচার মৃত্যুদণ্ড এই নৃশংস হত্যাকান্ডে কঙ্গোর প্রায় ১০ মিলিয়নের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেমৃত্যুদণ্ড কার্যকারী করতে যাতে বেশি গুলি অপচয় না হয় তার জন্য সরকারি নির্দেশে সেনাবাহিনীকে প্রতি গুলির বিনিময়ে একটি করে কাটা কব্জি জমা দিতে হতউদ্দেশ্য ছিল কঙ্গোবাসী রবার সংগ্রহে জোয়ার আনবেকিন্তু ঘটল বিপরীত রাবার সংগ্রহের চেয়ে কাঁটা হাত সংগ্রহ করা সহজসাধ্য ছিলফলে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে  হিড়িক পড়ে যায়রাবার সংগ্রহের কাজটি লোমহর্ষক নিষ্ঠুরতায় পর্যবসিত হয়শুরু হয় কঙ্গোর গৃহযুদ্ধ যা আফ্রিকার মহাযুদ্ধ নামে পরিচিত এই মহাযুদ্ধের ফলে বাম্বেঙ্গা নামে একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠী নরমাংস ভক্ষনকারীতে রুপান্তরিত হয়
১৮৩০ এর দশকে ফ্রান্স আফ্রিকায় তার উপনিবেশের সূচনা করেপ্রায় ১৩০ বছরেরশাসনে ফ্রান্স ২০ লাখের বেশি আলজেরিয়ানকে হত্যা করে১৯৩৯ সালের মিত্রশক্তির সদস্য ফ্রান্সের উপনিবেশ হওয়ায় আলজেরিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি জয় লাভ করে বিজয় উদযাপন উপলক্ষে মে আলজেরিয়ানরা, আলজেরীয় পতাকা হাতে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দিন দিন ফরাসি সৈন প্রায় এক হাজার নিরস্ত জনগনকে হত্যা করেফলে সারা দেশব্যাপক গনউষ্মায় ভেঙে পড়ে ১০৩ জন ফরাসি নিহত হয়এর প্রতিক্রিয়ায় ফরাসি সেনা সারা আলজেরিয়া জুড়ে গনহত্যায় মেতে ওঠেমাত্র পাঁচ দিনেবিদ্রোহ দমনের ফরাসি সেনা ৪৫ হাজার জনসাধারণকে হত্যা করেশেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালে ফ্রান্স আলজেরিয়ার স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়তবে এই সময়ের ব্যবধানে অভিযান  বিচারের নামে ১০ লাখ আলজেরীয় হত্যার স্বীকার হয়

ইতিহাসে যে কয়েকজন গননিধনকারী ছিলেন তাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি চর্চিত বন্দিত হিটলারপ্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিরপরাজয় নাৎসি দলের নেতা জার্মানির ক্ষমতা দখল করে বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়তিনি ছিলেন ইহুদি নিধনের হোতা১৯৪১-৪৫ সালের মধ্যে তিনি প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করে,এর মধ্যে প্রায় দেড় মিলিয়ন ছিল শিশু মহিলা খুব অল্প সময়ের মধ্যে এহেন হত্যাযজ্ঞের নজির ইতিহাসে নেইজার্মানি  থেকে ইহুদি বিতাড়নের জন্য ১৯৩৫ সালে আইন পাশ হয়প্রাথমিক পর্যায়েদুই মিলিয়ন ইহুদিকে গুলি করে হত্যা করা হয়১৯৪২ পরবর্তী কালে ইহুদিদের ভয়াবহ অবস্থায় বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হত পথে যারা অত্যাচার থেকে বেঁচে যেত তাদেত গ্যাস চেম্বারে নিয়ন্ত্রিতপদ্ধতিতে হত্যা করা হত


ভারত তথা বিশ্বে কালে কালে ঘটা গণহত্যা গুলি ঘটেছে জাতিগত ধর্মীয় রাজনৈতিক কারনে প্রাচীন মধ্যযুগে গনহত্যার পিছনে ধর্মীয় ভাবাবেগ কাজ করেছিল সবথেকে বেশিআধুনিককাল তথা বর্তমানে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়ায়ে বলি হয়েছে বা হচ্ছে নিরিহ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে রাষ্টীয় মদতে ঘটানো হচ্ছে এই নরহত্যালিলা যা কোন দেশের পক্ষে সুখকর হতে পারেনা অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বহু জাতি অধ্যাসিত দেশে পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ উত্তেজনা বৃদ্ধি করে চলেছে অবশ্য কিছু উগ্র রাজনৈতিক দল অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার জিগির তুলে বর্তমান পরিস্থিতিকে বিষময় করে তুলতে কিছু কম করে নাএখন গণতান্ত্রিক পরিবেশে রাজা,সম্রাট স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রনায়কেরা নেই ঠিকই কিন্তু রাজনৈতিক দল গুলির দুর্বলতা নীতি নির্ধারনে ত্রুটিরফলে গনহত্যা হয়ে থাকেআধুনিক যুদ্ধে মারনাস্ত্রের প্রয়োগের ফলে বিরোধী শক্তির যত না ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছেএই বিষয়টি নিয়ে আন্তজাতিক স্তরে বহু পর্যালোচনা হলেও কার্যক্ষেত্রে সাফল্য তেমন চোঁখে পড়েনা


Share on Google Plus Share on Whatsapp



0 comments:

Post a Comment