ফারুক
আব্দুল্লাহ:কোন শক্তিশালী
দেশ এবং তার মজবুত শাসন ব্যাবস্থা গড়ে
তোলার পেছনে সে দেশের গুপ্তচর ব্যাবস্থার
অবদান অনস্বীকার্য।ভারতবর্ষে সেই প্রাচীন কাল থেকেই গুপ্তচর ব্যাবস্থা বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন নামে চলে আসছে ।একটা সময়
এই গুপ্তচর ব্যাবস্থাকে রাজার চোখ এবং কানের সাথে তুলনা করা হত কারন এই গুপ্তচরদের
মাধ্যমেই রাজ্যের বিভিন্ন খবর
যেমন,প্রাদেশিক শাসকদের কার্যকলাপ,প্রজাদের অবস্থা, দেশে কোথাও রাজার বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা এই সমস্ত খবর রাজারা সংগ্রহ করতেন। রাজা ও রাজ্যকে সুরক্ষিত
রাখতে ও সুষ্ঠ ভাবে শাসন ব্যাবস্থা পরিচালন করতে গুপ্তচর ব্যাবস্থার জুড়ি মেলা
ভার। গুপ্তচর ব্যাবস্থা কোন দেশের মেরুদন্ড স্বরপ।
প্রাচীন ভারতের
শক্তিশালী রাজবংশের মধ্যে মৌর্যরা ছিল অন্নতম।এবং মৌর্যদের শক্তিশালী প্রশাসন
ব্যাবস্থার মূল ভিত্তি ছিল এই গুপ্তচরেরা
দেশের বিরুদ্ধে সমস্ত রকমের ষড়যন্ত্রের সম্ভবনাকে নির্মূল করে দেশকে নিরাপদ
রাখত।গুপ্তচরদের গুরুত্ব কোন মন্ত্রিদের থেকে কম ছিল না।
মৌর্য আমলে গুপ্তচরদের কথা জানা যায় কৌটিল্যের
অর্থশাস্ত্র এবং বিভিন্ন গ্রীক লেখকদের রচনা থেকে। মৌর্যযুগে প্রধানত দুই ধরনের
গুপ্তচর ছিল ‘সামাস্থা’ ও ‘সঞ্চরা’ নামে এছাড়া অর্থশাস্ত্রে আরও ৫ প্রকার
গুপ্তচরদের কথা বলা হয়েছে।
১)কপতিকাছাত্র
বা শিক্ষার্থীঃ মৌর্যযুগে দেশের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের
মধ্যে থেকেও গুপ্তচর নিযুক্ত করা হত, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সেই সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে যারা মূলত
গবেষণার সাথে যুক্ত ছিল।এ ভাবেই এই সমস্ত শিক্ষার্থীরা একদিকে শিক্ষা লাভ করত অন্য
দিকে গুপ্তচর হয়ে দেশের এবং রাজার সেবা করত।এরা মূলত উঠতি শিক্ষার্থীদের চিন্তা
ভাবনা, তাদের মন মানসিকতার ওপর নজর রাখত।
২)উদাস্থিতা বা
কঠিন ধার্মিকঃ যে সব ধার্মিক ব্যাক্তির
সমস্ত বিষয়ে সমান জ্ঞানের অধিকারী হতেন সেই সমস্ত
ব্যাক্তিদের মধ্যে থেকেও গুপ্তচর নিয়গ করা হত।এই সব গুপ্তচররা সমাজের
বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের ওপর নজরদারি চালাতেন এবং কোথাও কোন অসঙ্গতি দেখলেই সঙ্গে
সঙ্গে রাজার কাছে অভিযোগ জানাতেন।
৩) গৃহপৈতিকা বা দরিদ্র কৃষক এবং গৃহস্থঃ সমাজের
সাধারণ মানুষদের কার্যকলাপ সম্পর্কে নজর রাখার জন্য গরীব কৃষক,সাধারণ গৃহস্থ,
এছাড়া স্রমিকদের মধ্যে থেকেও গুপ্তচর নিয়োগ করা হত। ফলে সমাজের নিচের স্তরের সব
খবরও রাজার কাছে পৌঁছে যেত।
৪)বৈদেহাক বা
অসফল বণিক বা ব্যাবসায়ীঃ অসফল ব্যাবসায়ীদের মধ্যে থেকেও গুপ্তচর নিয়োগ করা হত। এই
সমস্ত গুপ্তচররা বিভিন্ন বণিক এবং বিভিন্ন পর্যটকদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতো।
৫) ধর্মগুরুঃ
বিভিন্ন ধর্মগুরু দের মধ্য হতেও গুপ্তচর নিয়োগ করা হোটো।এই সব ধর্মীয় নেতারা
সমাজের সব শ্রেণীর মানুষদের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলতো ফলে তারা খুব সহজেই দেশ তথা
রাজা বিরোধী কাজ সম্পর্কে অবগত হতে পারতো।
এছাড়া মৌর্য যুগে নারী
গুপ্তচরের কোঠাও অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়। যারা বিভিন্ন গোপন খবর রাজাকে সরবরাহ
করতো।
স্বৈরাচারী
শাসান ব্যাবস্থায় অধীনস্ত প্রজা, কর্মচারী ও আঞ্চলিক প্রসাসনের ওপর কেন্দ্রীয়
সরকারের নিরন্ত অনুসন্ধান আবশ্যিক।তাই দিল্লীর সুলতানেরা সর্বদা অতি দক্ষ ও
সুসংগঠিত গুপ্তচরবাহিনী পোষণ করতেন। ‘বারিদ-ই-মুমালিক’ ছিলেন সুলতানি আমলে
গুপ্তচরবিভাগের প্রধান। এবং ‘বারিদ’ নামক গুপ্তচররা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খবর
সংগ্রহ করে তাদের প্রধান কে জানাত এবং সেই খবর অতি দ্রুত সুলতানের কর্ণগোচর করা
হত। ‘বারিদ-ই-মুমালিক’ দের যে কোন মুহূর্তে সুলতানের সাথে দেখা করার ও কথা বলার অধিকার
ছিল তবে গুপ্তচরদের প্রকাশ্য দরবারে হাজির হওয়া সুলতান পছন্দ করতেননা। অন্যদিকে
গুপ্তচররা সুলতানকে কোন ভুল সংবাদ প্রদান করলে তাদের কঠোর শাস্তির ব্যাবস্থা ছিল। বারণী লিখেছেন যে ‘সৎ,দয়ালু ও
নিরপেক্ষ ব্যাক্তিদের এই পদ গ্রহণে বাধ্য করা হত।কারন মনে করা হত এটি একটি
গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব।
মধ্যযুগে সুলতানি আমলে বিশেষ করে সুলতান বলবনের শাসন কালে।কারণ
সুলতান বলবন শাসনকার্যে অভিজাত শ্রেণীর প্রাধান্য কমাতে চেয়েছিলেন এবং তাই
অভিজাতদের সংগঠন ভেঙে দেন এবং অভিজাতদের বিরুদ্ধে তিনি গুপ্তচর নিযুক্ত করেন যাথে
তারা সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে না পারে, এবং এই সব গুপ্তচরদের অভিযোগের
ভিত্তিতে সুলতান বহু অভিজাতদের নির্মম ভাবে হত্যা করে তার সম্রাজ্যকে বিপদের হাত
থেকে রক্ষা কোড়েছীলেণ। এই সমস্ত কিছুর পেছনেই ছিল গুপ্তচরদের অবদান।
সুলতানি আমলের আর একজন বিখ্যাত সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর আমলে গুপ্তচরবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। রাজ্যের সমস্ত
ক্ষেত্রের সব ধরণের সংবাদ পাওয়ার জন্য সুলতান ‘বারিদ’, ‘মুনহি’, এবং ‘জাসুস’ নামক
অসংখ্য গুপ্তচর নিয়োগ করা হয় দেশ জুড়ে। বিখ্যাত পণ্ডিত বারণীর মতে ‘গুপ্তচর
ব্যাবস্থার ব্যাপকতার ফলে অভিজাতগন সর্বদা সংকুচিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন । এমনকি
তারা প্রকাশ্য স্থানে নিজেদের মধ্যে মত বিনিময়
করতে পারত না। গুপ্তচর ব্যাবস্থার ব্যাপকতার ফলে গোটা দেশ সন্দেহ ,অবিশ্বাসে ভরে
যায় ঠিকই কিন্তু সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সামান্যতম সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে
যায়।
পরবর্তীকালের মুঘলরা ছিল আরও শক্তিশালী শাসক।তারাও এই গুপ্তচর ব্যাবস্থার
ওপর নির্ভর করে একটি এই সুসংগঠিত সম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।মুঘলরাও একটি সু
শিক্ষিত গুপ্তচর বাহিনী পোষণ করতেন।মুঘলদের গুপ্তচররা সমগ্র দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল
সমস্ত শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে যেমন কৃষক,ভবঘুরে,পণ্ডিত এই সব শ্রেণীর
মানুষদের মধ্যে থেকেই গুপ্তচর নিয়োগ করা হত।এই সব গুপ্তচরদের প্রধান ছিলেন
দারগা-ই- ডাক চৌকি। এছাড়াও গোটা দেশ জুড়ে বিভিন্ন প্রদেশ গুলোর দরবারে থাকত সংবাদ
লেখক গন,যারা প্রাদেশিক শাসকদের বিভিন্ন কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করে তাদের বিভাগীয়
প্রধান এর কাছে প্রেরন করতেন এবং সেখান থেকে সংবাদ যেত মুঘল বাদশাহর কাছে।অনেক সময় এই সমস্ত সংবাদ লেখকদের সাথে প্রাদেশিক শাসকদের মনমালিন্য দেখাদিত।
অধিকাংশ সময় এই সব প্রাদেশিক শাসকরা নিজেদের কু কীর্তি লুকানোর জন্য সংবাদ লেখকদের
চাপ দিত,ফলে লেখকরা সেই
খবর দারগা-ই- ডাক চৌকির মাধ্যমে বাদশাহকে
জানাতেন এবং বাদশাহ ব্যাবস্থা
নিতেন সেই সব প্রাদেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে।
ভারতবর্ষে প্রাচীন থেকে মধ্য সব আমলেই গুপ্তচরদের অস্তিত্ব ছিল।
এবং
প্রতিটা শাসকই বিশৃঙ্খলা ও ষড়যন্ত্র মুক্তো সুসংগঠিত শান্তিপূর্ণ শাসন
ব্যাবস্থা
গঠনের উদ্দেশে গুপ্তচর বাহিনী পোষণ করতেন। কোন দেশের
গুপ্তচর
ব্যাবস্থা যত মজবুত হতো
সেই দেশ এবং তার শাসক ততোই শক্তিশালী হতো
তা
বলার অপেক্ষা রাখেনা। বৈদেশিক
আক্রমণের সম্ভাবনা এবং দেশের
আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা, শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
প্রভৃতির হাত থেকে দেশ ও
দেশবাসীকে সুরক্ষিত রাখতে যুগে যুগে এই গুপ্তচরদের অবদান
অনস্বীকার্য।
তথ্য
সূত্র
১) যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার- সংকলন ও সম্পাদনা, নিখিলেশ গুহ এবং
রাজনারায়ণ পাল
২) ভারত ইতিহাসের সন্ধানে- দিলীপ কুমার গঙ্গোপাধ্যায়
0 comments:
Post a Comment