ফারুক আব্দুল্লাহ : বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করেনা এমন মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন।এই
বিরিয়ানি আমাদের দেশে কবে,কিভাবে এলো তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আমাদের দেশে
বিরিয়ানির প্রচলন নিয়ে অনেক কাহিনী রয়েছে।ধারনা করা হয় যে,তৈমুর লং এর
ভারত আক্রমণের সময় নাকি তার হাত ধরেই বিরিয়ানি ভারতে প্রবেশ করে।
অপর একটি মত হল
মোঘল সম্রাট শাহজাহানের বেগম মুমতাজ মহল নাকি বিরিয়ানির উদ্ভব ঘটান।কোন একদিন বেগম
মুমতাজ মোঘল সৈন্যদের পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেন যে সমস্ত সৈন্যই অভুক্ত,তখন তিনি
এমন একটি খাবার তৈরি করার আদেশ দেন যাথে করে এক সাথেই সৈন্যদের কার্বোহাইড্রেড ও
প্রোটিনের চহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়।এই খাবারটিই পরবর্তী সময়ের জনপ্রিয় খাবার
বিরিয়ানি হয়ে ওঠে। আবার বেশ কিছু পণ্ডিতের মতে বর্তমান ইরান থেকে বিভিন্ন পর্যটক ও
বনিক শ্রেণীর হাত ধরেই নাকি বিরিয়ানি ভারতে প্রবেশ করেছিল।
এই বিরিয়ানি
মাংস,চাল ও মসলা যোগে রান্না করা হয়।প্রথম দিকে বিরিয়ানি রান্না করা হত গর্তের
মধ্যে।প্রথমে একটি পাত্রের মধ্যে চাল,মাংস,মসলা ও ঘি মেশানো হত,এবং একটি গর্ত খুড়ে
তার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে সেই পাত্রটি গর্তের মধ্যে রেখে তার ওপর মাটি চাপা দেয়া হত
এবং কিছুক্ষণ পর সেটি রান্না হয়ে গেলে পরিবেশন করা হত।
‘বিরিয়ানি’
শব্দটি এসেছে একটি পার্সি শব্দ বেরি(ন)থেকে যার অর্থ ভাজা করা। বিরিয়ানি একটি ভাত
জাতীয় খাবার।বিরিয়ানি মোঘল আমলে ভারতবর্ষে প্রবেশ করলেও তা অভিজাতদের খাবার
হিসেবেই বিবেচিত হত,ফলে দীর্ঘদিন এই সুখাদ্যটি সাধারন ভারতবাসীর ধরা ছয়ার বাইরেই
ছিল। এবং আনেক পরে এই বিরিয়ানি সাধারন মানুষের রান্না ঘরে প্রবেশ করে ও পরবর্তী
সময়ে বিরিয়ানিতে অঞ্চল অনুযায়ী না না বৈচিত্র্য যোগ হয়।ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে
এই বিরিয়ানি বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে থাকে
বিরিয়ানির প্রকারভেদঃ
লখনাওই বিরিয়ানি বা আওয়াধি বিরিয়ানিঃ এই বিরিয়ানি
মুলত উত্তর ভারতেই বেসি প্রচলিত।এই বিরিয়ানি ‘দম বিরিয়ানি’ ও ‘পুক্কা বিরিয়ানি’
নামেও পরিচিত ছিল।এই বিরিয়ানি মোঘল সম্রাট ও তার অভিজাতদের কাছে খুবই পছন্দনীয়
চিল।পরবরতি সময়ে অযোধ্যার নবাবদের পৃষ্টপোষকতায় এই বিরিয়ানি উৎকর্ষতা লাভ
করে এই বিরিয়ানি তৈরির পদ্ধতি ছিল,প্রথমে চাল এবং মাংস আলাদা করে রান্না করে
সেগুলি মসলা এবং ঘী দিয়ে এক সাথে মিশিয়ে আবার রান্না করা হত।
হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানিঃ এই বিরিয়ানি ভারতের
প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায়।হায়দ্রাবাদের নিজামদের পৃষ্টপোষকতায়
এই বিরিয়ানি চরম উৎকর্ষতা লাভ
করে চিল।এক সময় নিজাম এর রসুই খানাতে প্রতিদিন প্রায় ৪৯ রকমের বিরিয়ানি তৈরি করা
হত।হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি তৈরি করা হত চাল,মাংস মসলা একত্রে একটি পাত্রে চড়িয়ে। এই
বিরিয়ানি আবার ‘কাচ্চি ইয়েকনি’ নামেও পরিচিত ছিল।
তাহিরি বিরিয়ানিঃ টীপু সুলতান এর হাত
ধরেই বিরিয়ানি কর্ণাটক এ প্রবেশ করেছিল।কিন্তু এখানে বিরিয়ানিতে আনেক স্থানীয়
প্রভাব এসে পরে।টীপু সুলতান নিরামিষ ভোজী কর্ণাটকই ব্রাম্মনদের দ্বারা নিরামিষ
বিরিয়ানির উদ্ভব ঘটান যা ‘তাহিরি বিরিয়ানি’ নামে পরিচিত ছিল।এই বিরিয়ানি নানান
ধরনের সব্জির দ্বারা তৈরি করা হত।
বোম্বে বিরিয়ানিঃএই বিরিয়ানি বর্তমানে
মুম্বাই শহরের একটি জনপ্রিয় বিরিয়ানি।এই বিরিয়ানির উদ্ভবও মুম্বাইতেই। তবে এই
বিরিয়ানি অন্য বিরিয়ানির থেকে কিছুটা আলাদা।এই বিরিয়ানি তৈরি করতে মুলত লাগে
চাল,মাংস,লবন,পেয়াজ,আদা,রসুন বাটা,দই,সব ধরনের মসলা,লঙ্কা গুড়ো,আলু সহ আরও আনেক
কিছু।
আম্বার বিরিয়ানিঃ ভেলোরের আম্বার সহরে
এই বিরিয়ানির সৃষ্টি হয় ১৮ শতকে তখন এই শহর আর্কট এর নবাবের অধিন ছিল। আর্কট এর নবাবই এই বিরিয়ানির উদ্ভাবক
।বর্তমানে এই বিরিয়ানি
চেন্নাই,ব্যাঙ্গালোর এ ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বানিয়াম্বাদি বিরিয়ানিঃ বানিয়াম্বাদি
তামিলনাড়ুর একটি ছোট শহর।এই শহরটি আম্বার শহরের খুব কাছেই।বানিয়াম্বাদি বিরিয়ানিও
আর্কট এর নবাব এর দ্বারা প্রচলিত বিরিয়ানি।এই বিরিয়ানি তার সুগন্ধের জন্য বিখ্যাত।
ভাটকলি বিরিয়ানিঃএই বিরিয়ানি একটি
বিশেষ বিরিয়ানি যেটি মূলত কর্ণাটকের সমুদ্র উপকূলে পাওয়া যায়।এই বিরিয়ানি তার স্বাদ,রং,ও
সুগন্ধের জন্য বিক্ষাত।এই বিরিয়ানি মাছ ও মাংস সব দিয়েই বানান যায়।
মালাবার বিরিয়ানিঃএই বিরিয়ানি কেরালার
সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার একটি জনপ্রিয় খাবার।এই বিরিয়ানি ভারতে প্রচলিত বিরিয়ানি
গুলির থেকে আনেকটাই আলাদা। এই বিরিয়ানি সব রকম মাংস দিয়েই করা করা যেতে পারে,শুধু
তাই নয় এই বিরিয়ানিতে মাছ ও ব্যাবহার করা যেতে পারে।এই বিরিয়ানি তে স্থানীয় আনেক
মসলা ব্যাবহার করা হয়ে থাকে।
দিন্দিগুল বিরিয়ানিঃ এই বিরিয়ানির প্রচলন
করে দক্ষিণ ভারতের এক মুসলিম জনগোষ্ঠী।কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই বিরিয়ানি তেলেগু
ভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়, এই বিরিয়ানি স্বাদে ও গন্ধে অপূর্ব।
কোলকাত্তা বিরিয়ানিঃ এই কোলকাত্তা
বিরিয়ানি আনেকটাই আওয়াধি বিরিয়ানির মতই। অযোধ্যার নবাব
ওয়াজেদ আলি ১৮৫৭ সালের পর কলকাতাই নির্বাসিত হয়ে এলে তিনি এই কোলকাত্তা
বিরিয়ানির উদ্ভব ঘটান।তিনি প্রথম বিরিয়ানিতে ক্যাওড়ার জল ও গোলাপ জল এর ব্যাবহার
চালু করেছিলেন। নবাবের অর্থাভাবের জন্য বিরিয়ানিতে মাংসের পরিমান কমিয়ে আলু দেয়ার
প্রচলনও নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ ই করেছিলেন
বলে জানা যায়।
একটা সময় বিরিয়ানি সমাজের একটা বিশেষ শ্রেনির মানুষদের
মধ্যে আবদ্ধ থাকলেও আজ বিরিয়ানি সবার রান্না ঘরে পৌঁছে গেছে । বিরিয়ানি আজ শুধু
মাত্র ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যেই সিমাবদ্ধ নয়,বিরিয়ানি সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে
পড়েছে এবং বিরিয়ানি নিজ মহিমাতেই
প্রতিটি মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছে।
তথ্য সূত্র:
1)khanapakana.com
2)culinarycafe.org
3)toprecipes.blurtit.com
4)squidoo.com
5)blogs.hindustantimes.com
6)wikipedia.org
7)historyofbiriyani.weebly.com
8)timesofindia.indiatimes.com
0 comments:
Post a Comment