‘অঞ্জনা’,নদী বহমানতা হারিয়েছে সাধারণ মানুষের গ্রাসে!




সঞ্চিতা সিনহা:


"অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে, পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে। জীর্ণ ফাটল-ধরা----এক কোণে তারি, অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী"


অঞ্জনা নদীর কথা স্মরণে আসে রবী ঠাকুরের এই কবিতাটি পড়লেই। একসময়ে অঞ্জনা নদী তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভোর করেছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। আর সেই জন্যেই মানুষের মননের কবি তাঁর কলমের ধারে  অঞ্জনা নদীকে অমর করে রেখেছিলেন কৃষ্ণনগরবাসীর হৃদ স্পন্দনে। 


 কবি মাইকেল মধুসূদন দও এই নদীর শোভা দেখে বলেছিলেন - 


" হে অঞ্জনে , তোমাকে দেখিয়া অতিশয় প্রীত হইলাম , তোমাকে কখনই ভুলিব না এবং তোমার বর্ণনা করিতে এূটি রাখিব না " ।


 বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কৃষ্ণনগরে বসবাসের সময় অঞ্জনার রূপ দেখে মোহিত হয়েছিলেন এবং একটি গানও লিখেছিলেন -


 " নদীর নাম অঞ্জনা , নাচে তীরে খঞ্জনা..."


কিন্তু বতর্মানে  অঞ্জনা নদী অবলুপ্তির পথে। কারণ সাধারণ মানুষের লালসা ও লোলুপ দৃষ্টি।  আর এরই ফলস্বরূপ রবি ঠাকুরের স্রোতস্বিনী অঞ্জনা নদীর চলার গতি হয়েছে সংকীর্ণ। ইট, বালি, পাথরের ইমারতের চাপে  বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে রবি ঠাকুরের স্রোতসিনী অঞ্জনা। নদীর মাজা ভেঙ্গে গেছে । অঞ্জনা বাঁচাও অঞ্জনা বাঁচাও বলে বিভিন্ন সংস্থা চিৎকার করলেও অঞ্জনা আছে অঞ্জনাতেই। মনুষ‍্য সমাজের লোলুপ দৃষ্টি তাকে ছাড়েনি।লোক দেখানো তৈরী হয়েছে অঞ্জনা বাঁচাও কমিটি। কিন্তু তারাও অঞ্জনার চিৎকার শুনতে পায়নি।  


 অঞ্জনা নদীর  উৎপত্তি কৃষ্ণনগরের প্রান্তে শ্মশান কালীবাড়ির কাছে জলঙ্গী নদী থেকে। এরপর এই নদী  জেলা পরিষদের পেছন দিয়ে বেজিখালি হয়ে রাজবাড়ির সামনে দিয়ে শক্তিনগর হাসপাতালের পাশ দিয়ে শহরের শেষে দোগাছি এলাকায় মিশেছে। সেখান থেকে আবার ধাবিত হয়েছে  হাটবোয়ালিয়া এখানে নদী দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে।  একটি অংশ জালালখালি, জলকর পাটুলি, বাদকুল্লা, চন্দনপুকুর হয়ে ৩৪ নম্বর ব্যাসপুর মৌজার কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে। হেলেরখাল নামে পরিচিত অন্য অংশটি হাটবোয়ালিয়া থেকে যাত্রাপুর, জয়পুর, গোবিন্দপুর, ইটাবেড়িয়া, হয়ে হাঁসখালির কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে। অঞ্জনা নদী হল জলঙ্গী ও চূর্ণী নদীর সংযোগস্থাপক। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭ কিলোমিটার। যার মধ্যে কৃষ্ণনগর শহর জুড়ে আছে ৭ কিলোমিটার।

জনশ্রুতি অনুসারে, রাজা রুদ্র রায়ের আমলে অর্থাৎ ১৬৮৩ থেকে ১৬৯৪ সালে মুর্শিদাবাদের নবাবদের কয়েকটি নৌকা অঞ্জনা নদীর উপর দিয়ে যাতায়াত করত। রাজবাড়ির একদম পাশ দিয়ে  নদী প্রবাহিত হওয়ার  জন‍্য ব‍্যবসা বাণিজ্যে আপত্তি তোলেন রাজা রুদ্র রায়। এজন্য মুর্শিদাবাদের  নবাবের সঙ্গে রাজা রুদ্র রায়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয় । যুদ্ধের ফলশ্রুতিরূপে  অঞ্জনার মুখ কিছুটা বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে নৌকা যাতায়াত সম্ভব না হয় । তবে অবশ‍্য ইতিহাসের পাতায় এ নিয়ে দ্বিমতও রয়েছে ৷ অনেকেরই মতে বহিরাগতদের শহরে প্রবেশের উপরে নিয়ন্ত্রণ আনতে নদীর উৎসমুখ ছোট করে দেওয়াও অঞ্জনার বেহাল দশার জন্য দায়ী।

নদীর দুই পার দখল করে  নির্মাণকার্য  চলেছে যার ফলে নদী ক্রমশ  খাল থেকে নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এর দরুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শহরের নিকাশি ব্যবস্থার। নদী এখন  খালে পরিণত হয়েছে । বর্তমানে এই নদীকে দেখলে মনেই হয়  না কোন একসময় এই নদীর সজীব বহমানতায় মুগ্ধ হয়ে রবী ঠাকুর ‘অঞ্জনা নদীতীরে’ কবিতা লিখেছিলেন।

Share on Google Plus Share on Whatsapp



0 comments:

Post a Comment